নাটোর জেলা ভ্রমণ

বাংলাদেশ পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ। আমাদের মাতৃভূমির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উত্তরের জনপদ নাটোরের রয়েছে ইতিহাস সমৃদ্ধ পর্যটন এলাকা। নাটোরের পর্যটন নিয়ে আলোচনার আগে চলুন জেলা নাটোর সম্পর্কিত কিছু প্রশাসনিক তথ্য জেনে নিই।

20181126_190024.jpg
রানী ভবাণীর জমিদার বাড়ির সুদৃশ্য এক স্থাপনা   ©ছবি:লেখক 

নাটোরঃ
রাজশাহী বিভাগের আওতাধীন প্রশাসনিক অঞ্চল নাটোর। রাজশাহী জেলার অধীনে নাটোর মহকুমা গঠিত হয় ১৮৪৫ সালে। মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। নাটোর পৌরসভা দেশের অন্যতম পুরাতন প্রতিষ্ঠান। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নাটোর ৭নং সেক্টরের অধীন ছিল। এই জেলার উত্তরে নওগাঁ ও বগুড়া জেলা, দক্ষিণে পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলা, পূর্বে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে রাজশাহী জেলা অবস্থিত। বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে কমবৃষ্টিপাত হয় নাটোরের লালপুর উপজেলায়। জেলাটি ৭টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত।

20181126_190046.jpg
রাণী ভবাণীর জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়   ©ছবি:শিহাব আহমেদ

প্রধান নদীসমূহঃ
পদ্মা, বড়াল, মরা বড়াল, বারনাই, গুড়। *চলনবিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(নাটোরসহ পার্শ্ববর্তী বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে অবস্থিত চলন বিল হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল।)
দর্শনীয় স্থানসমূহঃ
১.উত্তরা গণভবন।
২.রাণী ভবানীর রাজবাড়ী।
৩.দয়ারামপুর রাজবাড়ি।
৪.বনপাড়া লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী।
৫.চলন বিল।
৬.চাপিলা শাহী মসজিদ, গুরুদাসপুর।

20181126_185844.jpg
উত্তরা গণভবনের মনোরম দৃশ্য   ©ছবি:লেখক

কিভাবে নাটোর যাবেন-
ঢাকা থেকে বাস যোগেঃ
বাসে করে ঢাকা থেকে নাটোর যেতে বেশ কয়েকটি কোম্পানীর বাস পাবেন। এদের মধ্যে সরকার ট্রাভেলস, গ্রীণ লাইন, দেশ ট্রাভেলস, হানিফ, শ্যামলী এবং ন্যাশনাল পরিবহন উল্লেখ্যযোগ্য। ঢাকার কল্যানপুর, গাবতলী এবং মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরের উদ্দেশ্যে এসব পরিবহণের বাসগুলো নিয়মিতভাবে চলাচল করে। নন-এসি, ডিলাক্স,সাধারণ ও এসির গাড়ির টিকেট মূল্য ৩৮০-৬০০ টাকার মধ্যে। সময় লাগবে ৬ঘন্টার মতো।
ট্রেনযোগে ঢাকা-নাটোরঃ
উত্তরাঞ্চলগামী প্রায় সকল ট্রেনই নাটোর স্টেশনে যাত্রাবিরতী করে। তাই ট্রেন যোগেও সহজে নাটোর যেতে পারবেন। টিকিটের দাম পড়বে ক্যাটাগরী ভেদে ২৭০-৯৫০ টাকা।
বাসস্ট্যান্ড বা রেলস্টেশন, যেখানেই নামুন না কেন উত্তরা গণভবন কিংবা রাণী ভবানীর জমিদার বাড়ি যেতে আপনার রিক্সা বা অটোরিক্সা ভাড়া যাবে ১০-৩০ টাকা।
বগুড়া থেকে নাটোর যাবেন যেভাবেঃ
বগুড়া থেকে নাটোর যেতে অনেক বাস পাবেন। বগুড়া শহরের চারমাথা ও শাকপালা বাসস্ট্যান্ডে একটু দাড়ালেই বাস পাবেন। ভাড়া নিবে ৪০-৫০ টাকা, সময় লাগবে ঘন্টা খানেকের মতো। যাত্রা পথে সিংড়ায় চলন বিল দেখতে পাবেন,এজন্য আপনাকে বর্ষাকালে যেতে হবে। চাইলে ট্রেনে করেও বগুড়া থেকে নাটোর যেতে পারেন। তবে বাস সার্ভিসই ভালো হবে আমার মতে।
কোথায় থাকবেনঃ
নাটোর ট্যুরে এসে থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না! কারণ খুব ভোরে নাটোর পৌছালে সারাদিন প্রধান প্রধান স্পটগুলো ঘুরে চাইলে সন্ধ্যা বা রাতের গাড়িতেই ফিরতে পারবেন। কিন্তু কেউ যদি সময় নিয়ে সব দেখতে চান তবে সেক্ষেত্রে আপনাকে রাত্রীযাপন করতে হবে। নাটোরে মোটামুটি মানের বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ও বোডিং রয়েছে। এর মধ্যে হোটেল ভি.আই.পি, হোটেল প্রিন্স, হোটেল রুখসানা, হোটেল রাজ, হোটেল মিল্লাত অন্যতম। ভাড়া পড়বে সিঙ্গেল এবং ডাবল কেবিন ২০০-৬০০ টাকার মধ্যে।
এছাড়াও রয়েছে সার্কিট হাউস, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। তবে আপনাকে এসব জায়গায় থাকতে আগাম অনুমতি নিতে হবে।

Untitled-1.jpg
উত্তরা গণভবন ্এবং জমিদার বাড়ির তথ্যবহুল চার্ট    ©ছবি:লেখক

কোথায় খাবেনঃ
নাটোরে খাবার নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নাই। খাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি ভালোমানের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এসব রেস্টুরেন্ট বা হোটেলে সকাল, দুুপুর কিংবা রাতের খাবার আরামে খেতে পারবেন। খাবারের দাম স্বাভাবিক। নাটোরের বিখ্যাত ‘কাচাগোল্লা’ খেতে কিন্তু ভুলবেন না। দারুণ স্বাদের এই মিষ্টান্ন অবশ্যই পরখ করে দেখবেন, এই ‘কাচাগোল্লার’ সুনাম কিন্তু বিশ্বময়!
চলুন এবার নাটোরের প্রধান প্রধান পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে দেখি!

20181126_185826.jpg
উত্তরা গণভবনের ভিতরের একটি স্থাপনা   ©ছবি:লেখক

দিঘাপতিয়ায় প্রতিষ্ঠিত জমিদার বাড়িটি বর্তমানে উত্তরা গণভবন নামকরণ করা হয়েছে। এর আগে এর নাম ছিল গভর্নর হাউজ। নাটোর জেলা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উত্তরা গণভবনটি বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর স্থানীয় কার্যালয় এবং বাসভবন হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রায় ৪৩ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত উত্তরা গণভবন। রাজবাড়িটিতে মোট ১২ টি ভবন রয়েছে,আরো আছে স্বচ্ছ পানির লেক। ফুলে ফুলে সাজানো বাড়িটিতে রয়েছে প্রচুর আমগাছ। বিভিন্ন জাতের বিশাল আকৃতির আমগাছ গুলো দেখতে দারুন। যদি আমের মৌসুমে যান তাহলে বাড়তি আনন্দ পাবেন। টিকিট কেটে প্রবেশ দ্বারের বিশাল গেটটি পার হয়ে ভিতরে ঢুকলেই আপনার মন জুড়িয়ে যাবে। এখানে বিকেল ৫টার পর অবস্থান করার অনুমতি নেই, তাই সেভাবেই সময় করে চলে আসুন। নাটোর শহরের যে কোন স্থান থেকে রিক্সা বা অটোরিক্সায় এখানে আসতে পারবেন। উত্তরা গণভবনে সাপ্তাহিক বন্ধ রবিবার।

20181126_190136.jpg
রাণী ভবানীর জমিদারবাড়ির প্রবেশ পথ   ©ছবি:লেখক

এবার চলুন যাই জীবনানন্দ দাশের কবিতার বিখ্যাত রাণী ভবানীর রাজবাড়ী। এখানেও টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয়। শহরের যে কোন প্রান্ত থেকে রিক্সা বা অটোরিক্সা যোগে এখানে আসা যায়। নাটোর শহরে ঘোরাফেরার জন্য রিক্সা বা অটোরিক্সা রিজার্ভ না করাই ভালো, কারণ শহরের আশেপাশে সব জায়গাতেই এসব গাড়ী চলাচল করে। রাণী ভবানীর জমিদার বাড়িতে আপনি সে সময়ের সকল স্থাপনা দেখতে পাবেন। বড় বড় পুকুর রয়েছে এখানে, আছে শান বাধানো ঘাট। আসলে ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে হয় না, আপনি গিয়ে নিজের মতো করে ঘুরে দেখুন সব। রাণী ভবানীর জমিদার বাড়িতে সম্ভবত বিকেল ৫টার পর অবস্থান করা যায় না।

20181126_190008.jpg
জমিদার বাড়িটিতে রয়েছে এমন বড় বড় পুকুর   ©ছবি:লেখক

চলন বিলের যৌবন ভরা রুপ দেখতে আপনাকে ভরা-বর্ষায় যেতে হবে। নাটোর জেলার গুরুদাসপুর এবং সিংড়া উপজেলায় এর বিস্তৃতি। দেশের বৃহৎ এই বিল আপনাকে মুগ্ধ করবে শতভাগ। ঘুরে বেড়ানোর জন্য নৌকা রিজার্ভ নিতে পারবেন।

20181126_192410
চলন বিল   ©ছবি:জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট

চাইলে গোসল করতে পারেন এবং সাতাঁরও কাটতে পারেন। তবে পানিতে নামার আগে ভাবুন আপনি সাতাঁর জানেন কি না! না জানলে পানিতে পা ভিজানোর চিন্তাটাও না করা ভালো।
আমি মূলত নাটোরের প্রধান স্পটগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম, কারণ অামরা এই স্থানগুলোই শুধু ঘুরে দেখেছি। আপনারা অন্যান্য স্পট গুলো দেখতে চাইলে নিজের মতো করে ভ্রমন পরিকল্পনা সাজিয়ে ঘুরে দেখতে পারেন, ভালো লাগবে। নাটোরের স্পটগুলো দেখতে পরিবহন সংক্রান্ত কোন সংকটে পড়বেন না, সব রুটেই পর্যাপ্ত গাড়ী চলাচল করে।

20181126_185740.jpg
যানবাহন হিসেবে অটোরিক্সা পাবেন অনেক   ©ছবি:লেখক

এবার ফেরার পালাঃ
ঢাকায় ফিরতে চাইলে-
আপনি যেখানেই থাকুন না কেন প্রথমে নাটোর শহরে আসতে হবে। তারপর স্ট্যান্ডে গিয়ে টিকেট কাটতে হবে। যথেষ্ট বাস পাবেন ঢাকায় ফেরার জন্য। চাইলে ট্রেনেও ঢাকা ফিরতে পারেন।
বগুড়ায় ফিরতে চাইলে-
নাটোর শহরের র‌্যাবের কার্যালয়ের সামনে দাড়ালেই বগুড়া ফেরার গাড়ী পাবেন। সোজা কথা বগুড়া থেকে এসে যেখানে নেমেছেন সেখানেই বাস পাবেন।
মনে রাখবেনঃ
প্রত্যেকটা পর্যটন এলাকা আমাদের জাতীয় সম্পদ। অতএব এর ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না। পরিবেশ পরিস্কার রাখুন। বেড়াতে গিয়ে সব কিছু চাহিদামতো রাজকীয় পাবেন এ চিন্তা এড়িয়ে চলুন! প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষের সহযোগীতা নিন,স্থানীয় মানুষদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। বিপদে পড়লে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগীতা নিন। ভ্রমন করুন, দেশকে জানুন।
আপনার ভ্রমন হোক নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।
*আমাদের ভ্রমনের সময়ের আলোকে লেখা। অতএব সময়ের সাথে সব ধরনের ভাড়া, গাড়ির সময় ইত্যাদি পরিবর্তন হতে পারে।
*লেখকের পূর্বানুমতি ছাড়া পুরো বা কোন অংশ এডিট কিংবা কপি করা অনুচিত।
*কোন মতামত বা সংশোধনী কিংবা জিঙ্গাসা থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
*তথ্যগত সহায়তা ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া এবং জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে।
©কপিরাইট: আলমগীর হোসেন
TM:June 2018
TD:20 (0 night 1 day)

 

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s