শস্য-শ্যামলা আমাদের মাতৃভূমির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এমনই এক জেলা গোপালগঞ্জ। প্রকৃতির মায়া আর ইতিহাসের মিশেলে গোপালগঞ্জ জেলা এক কথায় অসাধারন! গোপালগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আলোচনা করবো, জানাবো কিভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন তবে তার আগে জেলা গোপালগঞ্জ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশাসনিক তথ্য জেনে নেই।

গোপালগঞ্জ জেলা:
১৮৭২ সালে মাদারীপুর মহকুমায় গোপালগঞ্জ নামক একটি থানা গঠিত হয়। ১৮৭৩ সালে মাদারীপুর মহকুমাকে বাকেরগঞ্জ জেলা থেকে পৃথক করে ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯০৯ সালে মাদারীপুর মহকুমাকে ভেঙ্গে গোপালগঞ্জ মহকুমা গঠন করা হয়। গোপালগঞ্জ এবং কোটালীপাড়া থানার সঙ্গে ফরিদপুর মহকুমার মুকসুদপুর থানাকে নবগঠিত গোপালগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯২১ সালে গোপালগঞ্জ শহরের মানে উন্নীত হয়। আদমশুমারি অনুযায়ী তখন গোপালগঞ্জ শহরের লোকসংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪ শত ৭৮ জন মাত্র। ১৯৭৪ সালে গোপালগঞ্জ সদর থানাকে ভেঙ্গে টুঙ্গিপাড়া নামক একটি থানা গঠন করা হয়। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ সরকার কর্তৃক প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের সময় গোপালগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এই গোপালগঞ্জেই জন্মগ্রহন করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সমাধী জেলার টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত।
বর্তমানে ৫টি উপজেলার সমন্বয়ে গোপালগঞ্জ জেলার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
অবস্থান:
গোপালগঞ্জ জেলার উত্তরে ফরিদপুর জেলা, দক্ষিণে পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলা, পূর্বে মাদারীপুর ও বরিশাল জেলা এবং পশ্চিমে নড়াইল জেলা অবস্থিত ।
আয়তন:
গোপালগঞ্জ জেলার আয়তন ১৪৮৯.৯২ বর্গ কিলোমিটার।
জেলার উপজেলা সমূহ:
১.টুঙ্গিপাড়া
২.কাশিয়ানী
৩.গোপালগঞ্জ সদর
৪.মুকসুদপুর
৫.কোটালিপাড়া

উল্লেখযোগ্য নদীসমূহ:
অনেক নদী সমৃদ্ধ জেলা গোপালগঞ্জ;
১.মধুমতি
২.বাঘিয়ার নদী
৩.ঘাঘর
৪.পুরাতন কুমার
৫.বিলরুট ক্যানেল (কৃত্তিমভাবে তৈরি করা হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে)
৬.কালিগঙ্গা
৭.টঙ্গীখাল
৮.দিগনার
৯.বাগদা
১০.কুশিয়ারা
১১.মধুপুর
১২.শৈলদহ
১৩.ছন্দা
দর্শনীয় স্থান:
১.জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধী সৌধ কমপ্লেক্স।
২.ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি।
৩.জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ী।
৪.অন্যন্যা চন্দ্র ঘাট, গোপালগঞ্জ সদর।
৫.উলপুর জমিদার বাড়ী।
৬.বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ, গোপালগঞ্জ সদর।
৭.বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।

কিভাবে আসবেন?
ঢাকা থেকে দুই পথে আপনি গোপালগঞ্জে আসতে পারবেন। রেলপথে আসতে পারবেন টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত। নতুন রেল লাইন নির্মান করা হয়েছে রাজবাড়ি থেকে গোপালগঞ্জ শহর হয়ে টুঙ্গিপাড়া পর্যন্ত। তাছাড়া সড়ক পথে আসতে পারবেন দুইটা ওয়েতে। মিরপুর ১২ থেকে স্বাধীন, গাবতলী থেকে বসুমতী, আব্দুল্লাহপুর থেকে প্রচেষ্টা সহ বেশ কিছু বাস মাওয়া ঘাট যায়, ভাড়া ৯০-১২০ টাকা। ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী ফেরীঘাটে আসবেন। সেখান থেকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস বাস পাবেন,অন্য বাস কোম্পানির বাসও পাবেন। কোন কোন বাসে উঠলে নামতে হবে গোপালগঞ্জে, আর কোন কোন বাস যায় টুঙ্গিপাড়া। ভাড়া ২০০-২৫০ এর মতো, সময় লাগবে ৩-৪ ঘন্টা। ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসে আসলে ভাড়া ৩৫০ টাকা পড়বে। মটর সাইকেল ভাড়াও পাবেন কাঁঠালবাড়ী ঘাটে, ভাড়া নিবে ১২০০-১৫০০ টাকা। সময় লাগবে ২ঘন্টার মতো। সময় স্বল্পতার কারনে আমরা মটর সাইকেল রিজার্ভ নিয়েছিলাম। আবার পাটুরিয়া ফেরীঘাট দিয়ে ফরিদপুর হয়ে গোপালগঞ্জে আসতে পারবেন। সাধারণত গোপালগঞ্জের মানুষ এই রুটটাই বেশী ব্যবহার করে, ভাড়া পড়বে ৩৫০-৪০০ টাকা। পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে চলছে, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে মাওয়া-জাজিরা রুটটাই বেশী ব্যবহৃত হবে। ঢাকার ছোট-বড় কয়েকটি স্ট্যান্ডে বাস পাবেন। চাইলে আগে পাটুরিয়া যেতে পারেন, তারপর লঞ্চে ফরিদপুর পৌছে গোপালগঞ্জের বাস ধরতে পারেন।

কোথায় থাকবেন?
গোপালগঞ্জ শহরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল পাবেন, কম বাজেটের হোটেলও পাবেন। খরচ পড়বে ২০০-১৮০০ টাকার মতো। চাইলে টুঙ্গিপাড়াতেও থাকতে পারেন, থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। তাছাড়া রয়েছে জেলা সার্কিট হাউজ, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, এখানে থাকতে আপনার আগাম অনুমতি সাথে আনতে হবে।
খাবার ব্যবস্থা:
খাবার সংক্রান্ত কোন ঝামেলা নেই। জেলার সর্বত্র সাধ্যের মধ্যে ভালো এবং স্বাস্থ্যকর খাবার পাবেন।
অভ্যন্তরীণ যানবাহন:
বাস, অটোরিক্সা, ম্যাক্সি, অটোভ্যান, রিক্সা, মটর সাইকেল ইত্যাদি বাহনে প্রয়োজন মেটাতে পারবেন।
চলুন এবার ঘুরিফিরি!

অনেক বকবক তো করলাম, চলুন এবার দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানি….
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধী সৌধ কমপ্লেক্স:
গোপালগঞ্জ হতে বাসে চড়ে টুঙ্গীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নেমে ভ্যান/অটোরিক্সা/ম্যাক্সিতে চড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধী সৌধ কমপ্লেক্সে আসতে পারবেন। এখানে আপনি বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতে পারবেন। দেখতে পারবেন বঙ্গবন্ধুর পৈত্রিক বাড়ী। বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান দেখতে পারবেন। এখানে একটি জাদুঘর ও লাইব্রেরী রয়েছে। সুবিশাল লাইব্রেরী থেকে জ্ঞান লাভের সুযোগ রয়েছে। জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে, রয়েছে তথ্য সমৃদ্ধ অনেক কিছু।

ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ি:
উপজেলা সদর হতে তিলছড়া বাসস্ট্যান্ড হয়ে পূর্ব দিকে বাইপাস সড়ক দিয়ে খাগড়াবাড়ীয়া-আড়ুয়াকান্দি হয়ে ওড়াকান্দি ঠাকুর বাড়ী যেতে পারবেন।

জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ী:
ভাটিয়াপাড়া থেকে এক কিলোমিটার উত্তরে ছোট কাচা রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে গেলেই জমিদার গিরীশ চন্দ্র সেনের বাড়ী।
অন্যন্যা চন্দ্র ঘাট:
উপজেলা পরিষদ, গোপালগঞ্জ সদর।
উলপুর জমিদার বাড়ী:
গোপালগঞ্জের কুয়াডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস যোগে উলপুর যেতে হবে।
বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধ:
উপজেলা পরিষদ, গোপালগঞ্জ সদর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস:
ছাত্রছাত্রী বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় এটা। গোপালগঞ্জ জেলা সদরেই এর অবস্থান। মনোরম এই ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে পারেন।

এবার ফেরার পালা:
ঢাকায় ফিরতে গোপালগঞ্জ জেলা সদরের বাসস্ট্যান্ডে চলে আসুন। এরপর টিকেট করে বাসে উঠে পড়ুন, রাতের সর্বশেষ বাস কখন ছাড়ে আগেই জেনে নিন। ট্রেনেও ফিরতে পারবেন। কাঁঠালবাড়ী-মাওয়া ঘাটে সারারাত ফেরি সার্ভিস চালু থাকে (যদি আবহাওয়া অনুকুলে থাকে)। তবে লঞ্চ এবং স্পিডবোট সার্ভিস সন্ধ্যা ৭-৮ পর্যন্ত চলে সম্ভবত।
মনে রাখবেনঃ
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধী সৌধের তথা কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষা করুন, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রত্যেকটা পর্যটন এলাকা আমাদের জাতীয় সম্পদ। অতএব এর ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না। পরিবেশ পরিস্কার রাখুন। বেড়াতে গিয়ে সব কিছু চাহিদামতো রাজকীয় পাবেন এ চিন্তা এড়িয়ে চলুন! প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষের সহযোগীতা নিন,স্থানীয় মানুষদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। বিপদে পড়লে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগীতা নিন। ভ্রমন করুন, দেশকে জানুন।
আপনার ভ্রমন হোক নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।
*আমাদের ভ্রমনের সময়ের আলোকে লেখা। অতএব সময়ের সাথে সব ধরনের ভাড়া, গাড়ির সময় ইত্যাদি পরিবর্তন হতে পারে।
*নদী এলাকা পার হতে হয়, তাই হঠাৎ প্রতিকূল আবহাওয়া হলে সমস্যায় পড়তে পারেন এজন্য আবহাওয়া বার্তা জেনে নিয়ে ভ্রমন পরিকল্পনা সাজান।
*একটা কথা বারবারই বলি, তা হলো যেখানেই ভ্রমনে যান না কেন ভাড়া, খাবার এ সব বিষয়ে দরদাম করে নিবেন। নইলে ঠকার সম্ভাবনা শতভাগ!
*নিজের সুবিধা মতো ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজান এবং সেভাবেই চলুন।
*লেখকের পূর্বানুমতি ছাড়া পুরো বা কোন অংশ এডিট কিংবা কপি করা অনুচিত।
*কোন মতামত বা সংশোধনী কিংবা জিঙ্গাসা থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
*তথ্যগত সহায়তা ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া এবং জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে।
©কপিরাইট: আলমগীর হোসেন
TM:March 2019
TD:06 (0 night 1 day)
১২.০৩.২০১৯
ধুনট, বগুড়া