আমাদের বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, এর পাশাপাশি রয়েছে বাঙালীর সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। এ অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে অনেক যুদ্ধ , রচিত হয়েছে ইতিহাস।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সুদীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ জেলা বগুড়া। আজ বগুড়া জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানাব এবং এসব স্থান কিভাবে ভ্রমণ করবেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা কেমন, কোথায় থাকবেন, কি খাবেন সব সব কিছু জানাব। চলুন পর্যটন নিয়ে আলোচনার আগে জেলা বগুড়া সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক তথ্য জেনে নেই।

বগুড়া জেলা:
দেশের প্রাচীনতম জেলা গুলোর বগুড়া একটি। ১৮২১ সালে বগুড়া জেলা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জয়পুরহাট জেলা বগুড়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল, ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের সময় জয়পুরহাট পৃথক জেলার মর্যাদা লাভ করে। বগুড়া উত্তরবঙ্গের একটি ঐতিহাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর। বগুড়া রাজশাহী বিভাগের অন্তর্ভূক্ত। বগুড়াকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এখানে ছোট ও মাঝারি ধরনের প্রচুর শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বগুড়া শহরের আয়তন ৭১.৫৬ বর্গকিলমিটার। বর্তমানে ভোটার বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় পৌরসভা এখন বগুড়া। এখানে “শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়াম” নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, যা উত্তরাঞ্চলের কয়েকটা জেলার মানুষের উন্নত চিকিৎসার অন্যতম আশ্রয়স্থল। জেলার প্রাচীনতম ইতিহাস রয়েছে। বগুড়া জেলা পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী ছিল। যা বর্তমানে মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। শহরে থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড় অবস্থিত, যা একসময় প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল এবং সেসময় পুণ্ড্রনগর নামে পরিচিত ছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমান বগুড়ার গাবতলীতে জন্মগ্রহণ করেন।

অবস্থান:
বগুড়া শহর করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত ।করতোয়া নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বগুড়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে । বগুড়ার উত্তরে গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা, পশ্চিমে নওগাঁ জেলা, দক্ষিনে সিরাজগঞ্জ জেলা এবং পুর্বে যমুনা নদী ।
বগুড়া জেলা ১২ টি উপজেলার সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহত্তর প্রাচীন জেলা।
আয়তন:
বগুড়া জেলার আয়তন ২৮৯৫.০১ বর্গকিলোমিটার।
উপজেলা সমূহ:
১.ধুনট
২.শেরপুর
৩.নন্দীগ্রাম
৪.বগুড়া সদর
৫.শিবগঞ্জ
৬.কাহালু
৭.সোনাতলা
৮.সারিয়াকান্দী
৯.শাহজাহানপুর
১০.গাবতলী
১১.দুপচাঁচিয়া
১২.আদমদীঘি।
উল্লেখযোগ্য নদ-নদী:
করতোয়া
বাঙ্গালী
যমুনা
নাগর

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব:
১.প্রফুল্ল চাকী (১৮৮৮-১৯০৮), ব্রিটিশ বিরোধী আন্দলনের নেতা ।
২.মোহাম্মদ আলী (মৃত্যু ১৯৬৯), কূটনীতিক এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ।
৩.মেজর জিয়াউর রহমান (১৯৩৬-১৯৮১) বীর উত্তম, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের প্রধান, সাবেক রাষ্ট্রপতি।
৪.খাদেমুল বাশার (১৯৩৫-১৯৭৬), বীর উত্তম, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার এবং বিমান বাহিনী প্রধান ।
৫.আখতারুজ্জমান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭), সাহিত্যিক ও গল্পকার ।
৬.গাজিউল হক (১৯২৯-২০০৯), ভাষা সৈনিক।
৭.এম. আর. আখতার মুকুল (১৯২৯-২০০৪), লেখক এবং সাংবাদিক ।
৮.মুশফিকুর রহিম, জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড় ।

বিখ্যাত খাবার ও পণ্য:
১.দই
২.মহাস্থানের কটকটি
৩.লাল মরিচ
৪.লাল আলু

অনেক তথ্য তো দিলাম,এখন চলুন জেনে নেই কি দেখবেন বগুড়ায় আর আসবেনই বা কিভাবে।
দর্শণীয় স্থান:
করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে সুফি, লালন, মারাঠি সংস্কৃতি সমৃদ্ধ বগুড়া জেলাকে বলা হয় উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার। পর্যটন সমৃদ্ধ বগুড়া জেলার দর্শনীয় ভ্রমণ স্থানগুলো-
১.শাহ সুলতান (র.) এর মাজার শরিফ
২.ভাসু বিহার
৩.মহাস্থান জাদুঘর
৪.বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘর
৫.গোবিন্দ ভিটা
৬.নওয়াব প্যালেস
৭.খেরুয়া মসজিদ
৮.পশুরামের প্রাসাদ
৯.ভবানীপুর মন্দির ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
১০. শহীদ চান্দু ক্রিকেট স্টেডিয়াম (উত্তরাঞ্চলের একমাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেণ্যু)।

আপনি ঢাকা থেকে বগুড়ায় সড়ক ও রেল পথ এই দুই উপায়ে আসতে পারবেন।
বিমানবন্দর থাকলেও বর্তমানে এটা বন্ধ আছে। ঢাকা থেকে বগুড়ার সড়ক যোগাযোগ খুবই ভালো, বর্তমানে ঢাকা-বগুড়া মহাসড়ক চারলেনে উন্নতীকরণের কাজ চলছে এটা হয়ে গেলে অতি অল্প সময়ে, সহজে বগুড়া আসতে পারবেন।
বাসে ভ্রমণ করলে:
ঢাকার গাবতলী, কল্যানপুর ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে হানিফ, শ্যামলী, এর আর ট্রাভেলস, মানিক, শাহ ফতেহ্ আলী, এনা, টি আর সহ অনেক পরিবহন কোম্পানির বাস বগুড়ার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ছেড়ে যায়। এসি, নন-এসি, ডিলাক্স ভাড়া পড়বে ৩০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত। একটু কম খরচে যেতে চাইলে টেকনিক্যাল মোড়ের আল মাহমুদ ফিলিং স্টেশন থেকে আর কে ট্রাভেলস এর বাসে চেপে বসতে পারেন, ভাড়া নিবে ২০০ টাকা। সময় লাগবে ৫-৬ ঘন্টা।
ট্রেনে ভ্রমণ করতে চাইলে:
ঢাকা থেকে বগুড়ায় ট্রেনেও আসতে পারবেন, তবে বাস যাত্রার চেয়ে সময় একটু বেশী লাগবে। কারণ ঢাকা থেকে বগুড়ার ট্রেন নাটোর-সান্তাহার স্টেশন হয়ে ঘুর পথে বগুড়ায় প্রবেশ করে ফলে সময় একটু বেশী লাগবে।

কোথায় থাকবেন:
বগুড়া শহরেই অবস্থান করে পুরো বগুড়া ঘুরে দেখতে পারবেন। বগুড়ায় থাকা সংক্রান্ত কোন ঝামেলাতেই আপনাকে পড়তে হবে না। উত্তরাঞ্চলের চার তারকা ও পাঁচ তারকা মানের দুটি হোটেল শুধু বগুড়াতেই রয়েছে। রয়েছে পর্যটন মোটেল, জেলা সার্কিট হাউজ, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো। সার্কিট হাউজ ও ডাকবাংলোতে থাকতে হলে আপনাকে অগ্রীম অনুমতি সাথে আনতে হবে। তাছাড়া বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্দ্যোগে প্রতিষ্ঠিত উন্নতমানের বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে বগুড়ায়। ২০০-৮০০০ টাকায় এসব হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।
খাবেন কি! :
বগুড়ায় ভালো মানের অনেক খাবার হোটেল রয়েছে। হোটেল আকবরিয়ার সুনাম দেশজুড়ে। বগুড়ার আসলেন আর দই খেলেন না তা হতে পারে না। বগুড়ার দইয়ের সুনাম বিশ্বময়। দই ও লাল মরিচ জেলার ব্র্যান্ড। তাছাড়া বগুড়ার মিস্টি, মহাস্থানের কটকটি পরখ করতে ভুলবেন না। এসব হোটেলে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার আরাম করে খেতে পারবেন।
চলুন এবার ঘুরে বেড়াই!
মহাস্থান ঘুরে দেখতে হলে;
মহাস্থানগড় মূলত বগুড়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ভাসু বিহার, পরশুরামে প্রাসাদ, বেহুলা লখিন্দরের বাসর ঘর, গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড় জাদুঘর, শাহ্ সুলতান (র.) এর মাজার শরিফ দেখতে চাইলে প্রথমে আপনাকে শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় আসতে হবে। অটোরিক্সা বা সিএনজি রিজার্ভ করে নিয়ে উপরের স্থান গুলো দেখতে পারবেন। শহরের অন্যান্য জায়গা থেকেও সিএনজি বা অটোরিক্সা রিজার্ভ করতে পারবেন। লোকসংখ্যা কম থাকলে বা বাজেটে ঘাটতি থাকলে রিজার্ভ না করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে গাড়ি ধরেও ভ্রমণ করতে পারবেন। এখানে আপনি প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুন্ড্রবর্ধণ নগরীর অনেক ধ্বংসাবশেষ সহ নানান স্থাপনা দেখতে পাবেন। পুরো একটা দিন চলে যাবে উপরে উল্লেখ করা স্থান গুলো দেখতে।

নওয়াব প্যালেস মিউজিয়াম:
এটা সাতমাথা থেকে দুই মিনিটের হাটা পথ, সাতমাথা থেকে পূর্ব দিকে শহীদ খোকন পৌর পার্ক এবং সার্কিট হাউজের পাশেই নবাববাড়ী রোডে প্যালেস মিউজিয়ামটির অবস্থান। ৫০ টাকায় টিকিট কেটে আপনি ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার এবং পাকিস্থানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মাদ আলী সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। বিনোদনের জন্য বেশ কিছু আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে আদিম গুহা!
খেরুয়া মসজিদ ও ভবানীপুর মন্দির:
খেরুয়া মসজিদ বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ। মসজিদটি বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলায় অবস্থিত। বগুড়া শহর থেকে উপজেলাটির অবস্থান ২০ কিলোমিটার দক্ষিনে, আসতে পারবেন বাসে করে। সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো, সাতমাথা থেকেই বাস পাবেন। শেরপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সা ভাড়া করে নিয়ে ঘুরে দেখে আসতে পারবেন ঐতিহাসিক খেরুয়া মসজিদ ।
ভবানীপুর মন্দিরটাও শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত, এখানে যেতে পারবেন সিএনজি বা অটোরিক্সা ভাড়া করে।

হাতে সময় থাকলে অবশ্যই আরো যা দেখার চেষ্টা করবেন!
১.বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং শীর্ষস্থানীয় কলেজ সরকারী আযিযুল হক কলেজ ক্যাম্পাস। এর অবস্থান পুরান বগুড়ায়। সাতমাথা থেকে সিএনজিতে পশ্চিমে ৫ টাকার পথ।
২. প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমানের পৈত্রিক নিবাস। এটা জেলার গাবতলী উপজেলার বাগবাটি গ্রামে অবস্থিত। যেতে পারবেন সিএনজিতে, সিএনজি পাবেন শহরের ইয়াকুবিয়া মোড় থেকে।
৩.বাংলাদেশ মসলা গবেষনা কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠানটি শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। মহাস্থানগড় জাদুঘর থেকে অল্প দুরত্বের পথ, কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন।
৪.প্রেম যমুনার ঘাট ও কালীতলা ঘাট। ঘাট দুটোর অবস্থান জেলার সারিয়াকান্দী উপজেলায়। আসতে পারবেন বাস বা সিএনজিতে। এখানে বসে বসে আপনি যমুনার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।

এবার ফেরার পালা:
ঢাকায় ফিরতে চাইলে চলে যান শহরের ঠনঠনিয়া বাসস্ট্যান্ডে। টিকিট কেটে উঠে পড়ুন বাসে! ট্রেনে যেতে চাইলে আপনাকে স্টেশনে যেতে হবে!
বগুড়ার সাথে প্রায় সকল জেলার বাস চলাচল ভালো, কিছু কিছু জেলায় সরাসরি বাস না চললেও লিংক সার্ভিস ঠিকই পাওয়া যায়। শহরের চার মাথা থেকে বিভিন্ন জেলার আন্ত:সার্ভিস বাস ধরতে পারবেন।
মনে রাখবেনঃ
প্রত্যেকটা পর্যটন এলাকা আমাদের জাতীয় সম্পদ। অতএব এর ক্ষতি হয় এমন কিছু করবেন না। পরিবেশ পরিস্কার রাখুন। বেড়াতে গিয়ে সব কিছু চাহিদামতো রাজকীয় পাবেন এ চিন্তা এড়িয়ে চলুন! প্রয়োজনে স্থানীয় মানুষের সহযোগীতা নিন, স্থানীয় মানুষদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। বিপদে পড়লে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা ট্যুরিস্ট পুলিশের সহযোগীতা নিন। ভ্রমন করুন, দেশকে জানুন।
আপনার ভ্রমন হোক নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব।
*সময়ের সাথে সব ধরনের ভাড়া, গাড়ির সময় ইত্যাদি পরিবর্তন হতে পারে।
*একটা কথা বারবারই বলি, তা হলো যেখানেই ভ্রমনে যান না কেন ভাড়া, খাবার এ সব বিষয়ে দরদাম করে নিবেন। নইলে ঠকার সম্ভাবনা শতভাগ!
*নিজের সুবিধা মতো ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজান এবং সেভাবেই চলুন।
*লেখকের পূর্বানুমতি ছাড়া পুরো বা কোন অংশ এডিট কিংবা কপি করা অনুচিত।
*কোন মতামত বা সংশোধনী কিংবা জিঙ্গাসা থাকলে কমেন্ট করতে পারেন।
*তথ্যগত সহায়তা ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া এবং জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে।
©কপিরাইট: আলমগীর হোসেন
১০.০৩.২০১৯
ধুনট, বগুড়া