উত্তরাঞ্চল অভিযান; রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী ভ্রমণ

বাংলাদেশ দেখার মিশনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, আরো বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ২০১৯ সালে জুনের ১৭ বা ১৮ তারিখ, ২জন বসে ভাবছি অল্প টাকায় একটা বড় ট্যুর দেয়া যায় কি না! মাথায় এলো উত্তরাঞ্চলের কথা। ২ ছোট ভাই আছে যার একজন বেরোবিতে আর একজন হাজী দানেশে পড়ে। ১৯ তারিখ সকালে তাদের ফোন দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম। রংপুর দিয়ে ট্যুর শুরু আর নীলফামারী দিয়ে শেষ করার পরিকল্পনা করলাম।
ঢাকা থেকে যেভাবে আসবেন:
আমরা বগুড়া থেকে গিয়েছিলাম। ৫ জনের একটা ছোট গ্রুপ ছিল আমাদের। তবে আপনি ঢাকা থেকে আসতে চাইলে সহজেই আসতে পারবেন। ঢাকা থেকে রংপুরের দুরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। শ্যামলী, ডিপজল, হানিফ সহ অনেক পরিবহন কোম্পানির বাস এ রুটে চলাচল করে। আসতে সময় লাগবে ৬-৭ ঘন্টা। ট্রেনেও আসতে পারবেন, তবে বাসের চেয়ে সময় একটু বেশী লাগবে। চাইলে বিমানেও আসতে পারবেন, নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে নামতে হবে।
ভ্রমণ যাত্রা: বগুড়া ৪ মাথা আন্ত:জেলা বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা থেকে আসা ডিপজল পরিবহনের গাড়ীতে উঠলাম সন্ধ্যা ৬টায়। ভাড়া নিল ১০০ টাকা। নামলাম রংপুরের মডার্ন মোড়ে। ছোট ভাই ফিরোজ এসে আমাদের তার মেসে নিয়ে গেল, বিশ্রাম নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার শেষে হাটলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বেশ রাতে রুমে ফিরে ঘুম।

FB_IMG_1588852035029

সকালে ঘুম থেকে উঠেই রওনা দিলাম তাজহাট জমিদার বাড়ির দিকে। অটোরিক্সা রিজার্ভ নিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে। আসা যাওয়া ভাড়া পড়েছিল জনপ্রতি ২০ টাকা। এই তাজহাট জমিদারবাড়ি একসময় হাইকোর্টের উত্তরাঞ্চল বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

FB_IMG_1588853685394

বর্তমানে এটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ এবং এখানে রংপুর যাদুঘর অবস্থিত। জমিদার বাড়িটিকে বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছে শোভিত করা হয়েছে।

FB_IMG_1588852070381

সেখান থেকে রংপুর শহরের বাইরের একটি পিকনিক স্পট দেখতে গেলাম। ভিন্নজগৎ বিনোদন পার্ক। রংপুরের পাগলাপীর হয়ে যেতে হয়, নিতে হবে অটোরিক্সা রিজার্ভ। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজ থেকে এখানে প্রতিবছর শিক্ষাসফরে আসে শিক্ষার্থীরা। এখানকার বিশেষ আকর্ষন কৃত্রিম সৌরজগত, আছে সুইমিং পুল সহ বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ সুবিধা। বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরী করা এ বিনোদন কেন্দ্রটিতে একসাথে ৫০০ টি পর্যন্ত গ্রুপের পিকনিক আয়োজন করা সম্ভব। সেখান থেকে শহরে এসে কারমাইকেল কলেজ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হয়ে ফিরলাম মেসে। আসার সময় ফিরোজ যে জিলাপিটা খাওয়ায় ছিলো তা ভোলার নয়!

FB_IMG_1588851975972

বিকেলেই রওনা দিলাম দিনাজপুরের উদ্দেশ্যে। রংপুর থেকে দিনাজপুর বাস ভাড়া ১০০ টাকা। রাত আটটা নাগাদ হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছালাম। রাতের খাবার শেষে মাঝরাত পর্যন্ত শিহাবের তাজউদ্দিন আহমদ হলের ছাদে আড্ডা দিতে দিতে পরের দিনের ট্যুর প্লান করে ফেললাম। সকালেই রওনা হলাম পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে। দিনাজপুর-পঞ্চগড় পর্যন্ত বাস ভাড়াটা মনে নেই। পঞ্চগড় শহরে নেমেই আরেকটি বাস ধরে তেঁতুলিয়া পৌছালাম।

FB_IMG_1588852295955

সেখান থেকে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট। চলার পথে দেখলাম সমতলের চা চাষ, রাস্তার দুইপাশে সারিসারি অনেক চা বাগান। বিজিবি কর্মকর্তা আসায় সীমান্তের দিকে যেতে একটু দেরি করতে বললো ডিউটিরত এক বিজিবি জওয়ান। এই সুযোগে দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলাম।

FB_IMG_1588852245572

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট আসলে কোন পর্যটন এলাকা নয়। এটা দেশের সর্ব উত্তরের ভূখন্ড। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারত, নেপাল, ভুটান থেকে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয় এবং প্লাস্টিক ও ঔষধ সামগ্রী রপ্তানি করা হয়।

FB_IMG_1588852327764

এ বন্দর দিয়ে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় পাথর, প্রতিদিন অসংখ্য ট্রাকে করে পাথর আসে ভারত থেকে। পাথরকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়বে আপনার, অনেক শ্রমিক কাজ করছে এখানে। এখানে ইমিগ্রেশন পয়েন্টও রয়েছে।

FB_IMG_1588852319651

পঞ্চগড় শহরে এসে একটু ঘুরেফিরে ছুটলাম ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে, উদ্দেশ্য দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় আম গাছ দর্শন। ঠাকুরগাঁও শহর থেকে লোকাল বাস ধরে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা সদরে যখন পৌছালাম তখন সূর্য ডুবতে আর আধ-ঘন্টার মতো বাকি আছে। নেমেই তাড়াহুড়ো করে অটোরিক্সা রিজার্ভ করে রওনা দিলাম হরিণমারী গ্রামের দিকে। সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম হরিণমারী, এখানেই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন আমগাছটি দণ্ডায়মান।

FB_IMG_1588852109816

যতক্ষণে ২০ টাকার টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম ততক্ষণে মাগরিবের আযান হয়ে গেছে। আলো-ছায়াতে দেখলাম আমগাছ সহ চারপাশ। ছবি উঠলাম কিন্তু অস্পষ্ট! বলা হয় আমগাছটি ২০০ বছরের পুরাতন এবং তিন বিঘা জমি জুড়ে এর ব্যাপ্তি। আমাদের আন্দাজে ২৫-৩০ শতাংশ জমির উপর এর ব্যাপ্তি। যাহোক গাছটি অনেক বড়, এর ডালগুলো অনেক মোটা হয়ে মাটি বেয়ে আবার নতুন একটি গাছের মতো উপরে উঠে গেছে।

FB_IMG_1588852101606

সেখান থেকে ফিরলাম বালিয়াডাঙ্গী সদরে, সন্ধ্যার নাস্তা সেরে ঢাকাগামী বাসে করে এসে নামলাম দিনাজপুরের দশমাইল নামক স্থানে, তারপর হাবিপ্রবিতে।

FB_IMG_1588852166651

রাতে ক্যাম্পাসে আড্ডা, ঘোরাঘুরি করে ঘুম। পরদিন খুব ভোরে উঠে রওনা হলাম দশমাইলের দিকে। উদ্দেশ্য কান্তজিও মন্দির ও নয়াবাদ মসজিদ দেখা। দশমাইল থেকে অটোরিক্সা রিজার্ভ নিয়ে গেলাম কান্তজিও মন্দিরে। দশমাইল থেকে ১৫-২০ মিনিটের পথ। এই মন্দিরটি দেশের অন্যতম পুরাতন মন্দির।

FB_IMG_1588852214580

১৭৫২ সালে মহারাজা প্রাণনাথ ও তার পোষ্যপুত্র রামনাথ কর্তৃক মন্দিরটি নির্মিত হয়। দুইবার বড় ভূমিকম্পে হ্রাস পেয়েছে মন্দিরটির উচ্চতা। মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যবিদরা এর নকশা প্রস্তুতকারী ও নির্মাতা। প্রতিবছর এখানে মেলা বসে, সে সময় দেশী বিদেশী পূর্ণার্থীর ঢল নামে কান্তজিও মন্দিরে। কান্তজিও মন্দির থেকে ঐতিহাসিক নয়াবাদ মসজিদটি অটোরিক্সা যোগে দশ মিনিটের দূরত্বে এবং দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ধারনা করা হয় কান্তজিও মন্দির নির্মান করতে আসা মুসলিম স্থাপত্যশিল্পীরা নিজেরা নামাজ পড়ার জন্য মসজিদটি নির্মান করেন, তবে এ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে স্থানীয়দের মাঝে।

FB_IMG_1588852204368

মসজিদের গায়ে স্থাপিত শিলালিপি থেকে জানা যায় মসজিদটি ১৭৯৩ সালে নির্মিত। নয়াবাদ মসজিদ ও কান্তজিও মন্দির দুটিই বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। ঐতিহাসিক স্থাপনা দুটি দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলায় অবস্থিত। সেখান থেকে রিজার্ভ অটোতেই ফিরলাম দশমাইল। দিনাজপুরের জনপ্রিয় পিকনিক স্পট স্বপ্নপূরী। তবে এখানে দুইবার গিয়েছিলাম তাই আবার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না! দশমাইল থেকে রংপুরের বাস ধরে সৈয়দপুর উপজেলা শহরে নামলাম। এখানে দর্শন করলাম সৈয়দপুর রেলওয়ে জংশন ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর। তবে আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিনি মসজিদ দেখা।

FB_IMG_1588852370077

ঐতিহাসিক চিনি মসজিদটি রেলওয়ে স্টেশনের নিকটেই। দেয়ালের গায়ে চীনা মাটির প্লেটের ভগ্নাংশ ব্যবহৃত হয়েছে বলে মসজিদটি চিনি মসজিদ নামে পরিচিত পেয়েছে।

FB_IMG_1588852381853

সৈয়দপুরে বিরাট সংখ্যার বিহারী ও অবাঙালীদের বসবাস রয়েছে। সৈয়দপুর অনেক বড় একটা শহর। আমার দেখা সবচেয়ে বড় উপজেলা শহর, কোন কোন জেলা শহরকেও ছাড়িয়ে যাবে এ শহর। সময় স্বল্পতার কারনে তিস্তা ব্যারেজ দেখা সম্ভব হয়নি। তখন বিকেল, রওনা হলাম রংপুরের দিকে। রংপুর থেকে বগুড়া পৌছালাম রাত ১১টার দিকে। ছোট বাজেটের দীর্ঘ জার্নির এক বড় ট্যুরের সমাপ্তি ঘটলো। আরো একবার যাব উত্তরাঞ্চল, দেখবো গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের রুপ।
থাকা-খাওয়া: যেসব জেলার বর্ণনা দিলাম এর কোন জেলাতেই আপনাকে রাতে থাকতে বা খেতে অসুবিধায় পড়তে হবে না। ৫০০-৫,০০০ টাকার মধ্যে মাঝারী থেকে উন্নতমানের অসংখ্য হোটেল পাবেন রাত্রিযাপনের জন্য। রংপুর বিভাগের একমাত্র ফাইভ স্টার হোটেল রংপুরে অবস্থিত। আঞ্চলিক খাবারগুলো খেতে ভুলবেন না! খাবারের দাম কমই।
সৈয়দপুর-ঢাকা: পঞ্চগড়, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁওয়ের বাসগুলো সৈয়দপুর হয়েই ঢাকা যায়। ঢাকায় ফিরতে বাস সংক্রান্ত কোন সমস্যা আপনাকে পড়তে হবে না। চাইলে ট্রেনেও ঢাকায় ফিরতে পারবেন। রয়েছে বিমান সুবিধা।
কিছু জরুরী কথা:
১. ছুঁটির দিন ও মৌসুম এড়িয়ে আসলে খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব।
২. স্থানীয়দের সাথে ভালো আচরণ করুন। তারা অনেক ভালো মনের মানুষ ও সাহায্যকারী।
৩. কোন সমস্যায় পড়লে পুলিশ কিংবা প্রশাসনের সহযোগীতা নিন। তারা সদা প্রস্তুত সহযোগীতা করতে।
৪. অনুনোমদিত কোন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
৫. পরিবেশ পরিস্কার রাখুন, মনে রাখবেন একজন প্রকৃত পর্যটক ও প্রকৃতি প্রেমী কখনো পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে না।
৬. স্যালাইন, প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ, স্যাভলন সাথে রাখবেন।
৭. সীমান্তবর্তী এলাকায় আিন মেনে চলুন, বেআইনী কাজ করে বিপদ ডেকে আনবেন না।
ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। নিজে ভালো থাকুন, প্রাণের দেশটাকে ভালো রাখুন। আল্লাহ হাফেজ।

আলমগীর হোসেন, ০৭.০৫.২০২০ খ্রিষ্টাব্দ

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s