পাহাড়ের নান্দনিক সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে কিছুই বলার নাই! বাংলাদেশ দেখার মিশনে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, এবার স্থির করলাম পাহাড়ে যাব। শুধু পাহাড় দেখবো আর ঘুরে বেড়াবো! গ্রুপের একজন বললো তাহলে কেওক্রাডং যাওয়া যাক, জায়গাটা আমার মাথাতেও ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুদিন যাবৎ, কিন্তু কাউকে বলছিলাম না দুর্গম আর ব্যয়বহুল ট্যুর হবে মনে করে! লুফে নিলাম প্রস্তাব। এখানে কেওক্রাডং অভিযানের কথা উল্লেখ করলাম কারন আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বগালেক ও কেওক্রাডং পর্বত অভিযান। আমি এ পর্বে বান্দরবান শহর ও এর আশেপাশের স্পটগুলো নিয়ে আলোচনা করবো। বগালেক ও কেওক্রাডং নিয়ে আমার আরেকটি লেখা আছে। যাহোক প্রতিবারের মতো অনেকের ট্যুরমেট হওয়ার কথা থাকলেও এবারও বেশীরভাগই কেটে পড়েছে! শেষমেশ ৬ জনের টিকিট কাটতে পারলাম। ঢাকা থেকে রওনা হয়েছিলাম ৫ মার্চ ২০২০ রাতে। চলুন বিস্তারিত গল্প শুরু করি!
কি কি দেখেছি:
১. বান্দরবান শহর।
২. স্বর্ণ মন্দির।
৩. শৈলপ্রপাত।
৪. নীলাচল পিকনিক স্পট।
৫. মেঘলা অবকাশ কেন্দ্র।
ঢাকা-বান্দরবান: ভ্রমণ মৌসুম ও সপ্তাহের শেষ কর্ম দিবস হওয়ায় আমরা সরাসরি বান্দরবানের টিকেট পাইনি। ঢাকা-বান্দরবান বাস ভাড়া নন-এসি ৬৫০ টাকা।কয়েকটি স্ট্যান্ড ঘুরে অবশেষে সায়দাবাদ থেকে চট্টগ্রামে রাতের বাস টিকেট কাটলাম। চট্টগ্রাম পৌঁছেছিলাম খুব ভোরে। নন-এসি ৪২০ টাকা ভাড়া নিয়েছিল ইউনিক পরিবহন। হানিফ, শ্যামলী, সেন্টমার্টিন পরিবহন সহ কয়েকটি কোম্পানির বাস এ রুটে চলাচল করে। সরাসরি বান্দরবানের টিকেট না পেলে আপনাকে চট্টগ্রাম হয়েই যেতে হবে। সকালের নাস্তা সেরে বহদ্দারহাট আঞ্চলিক বাস টার্মিনাল থেকে বান্দরবানগামী সকাল সাড়ে ৭টার বাস ধরেছিলাম। পূর্বাণী ও পূরবী নামের ২টি কোম্পানির বাস ৩০মিনিট পরপর চট্টগ্রাম-বান্দরবান রুটে চলাচল করে। ভাড়া ১৩০ টাকা, সময় লাগবে ২ ঘন্টার মতো।
বান্দরবানের স্পটগুলো ভ্রমণ:
বান্দরবানে সাধারনত যারা ১ বা ২ দিনের ট্যুরে যায় তারা এই স্পটগুলো ঘুরে বেড়ায়, আর এ রকম ট্যুরিস্টের সংখ্যাই বেশী। স্পটগুলো ঘুরতে ৫-৭ ঘন্টা সময় লাগে। আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু করুন। বান্দরবান নেমে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা শেষ করুন। এখন অটো বা চাঁন্দের গাড়ী স্ট্যান্ডে গিয়ে ভাড়া করুন গাড়ী। গ্রুপে সদস্য সংখ্যা বেশী হলে খরচ কম পড়বে। উপরে উল্লেখ করা স্পটগুলো দেখতে চাঁন্দের গাড়ী ভাড়া নেবে ২,০০০-২,৫০০ টাকা। অটো ৫০০-৬০০ টাকা। কঠিন দরদাম করে নিবেন, নইলে ঠকার সম্ভাবনা শত ভাগ! দূরের স্পটগুলো দেখতে চাইলে ভাড়া বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
স্পটগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা:
বান্দরবান শহর: শহরটা ছিমছাম মনে হয়নি আমার কাছে। তবে শহরটাতে অদ্ভূত এক মায়া আছে, বারবার যাওয়ার টান অনুভব করবেন! দূরের পাহাড় থেকে দেখলে দারুণ লাগে শহরটাকে।
স্বর্ণ মন্দির: শহরের পাশেই এর অবস্থান। উঁচু একটি পাহাড়ের চূড়ায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরটির কোথাও স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়নি, তবে সোনালী রঙ ব্যবহার করা হয়েছে বলে এটা স্বর্ণ মন্দির নামে পরিচিত পেয়েছে। মন্দিরটিতে প্রবেশ ফি ৫০ টাকা।
শৈলপ্রপাত: শহর থেকে একটু দূরে বান্দরবান-রুমা সড়কের পাশে এর অবস্থান। আমরা শুষ্ক মৌসুমে গিয়েছিলাম বিধায় এর আসল সৌন্দর্য দেখতে পাইনি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের দিকে এই জলপ্রপাতটির যৌবন দেখতে পাবেন।
নীলাচল পিকনিক স্পট: শহরের পাশেই উঁচু পাহাড়ের চূঁড়াতে এই পিকনিক স্পট বানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসন এর নিয়ন্ত্রন করে। দর্শনার্থী প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা। এখান থেকে বান্দরবান শহর পুরোটা ও স্বর্ণ মন্দির খুব ভালোভাবে দেখা যায়।
মেঘলা অবকাশ কেন্দ্র: শহরের প্রবেশ মুখেই এই স্পটটি অবস্থিত। জেলা প্রশাসন এই স্পটের নিয়ন্ত্রক। এখানে ঝুলন্ত সেতু, লেক, ক্যাবল কার, মিনি চিড়িয়াখানা, প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা আছে। অবকাশ কেন্দ্রের প্রবেশ ফি ৫০ টাকা।
থাকা-খাওয়া :
বান্দরবানে থাকা ও খাওয়ার কোন সমস্যা নেই। থাকার জন্য পাবেন ৫০০-৩,০০০ টাকা মূল্যের রুম। আমাদের ডাবল বেডের রুমভাড়া লেগেছিল ১,৬০০ টাকা। মাঝারী থেকে ভালো মানের অসংখ্য খাবার হোটেল পাবেন। পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর স্থানীয় খাবার খেতে ভুলবেন না। বান্দরবানের পাহাড়ী কলা, আনারস ও পেঁপের সুনাম সর্বত্র।
এবার ফেরার পালা:
আগেই বলেছি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বগালেক ও কেওক্রাডং ট্যুর। ফেরার পথে আমরা এসব দেখেছি। আমরা বান্দরবান থেকে রাঙ্গামাটি গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই ঢাকায় ফিরেছি। আপনি বান্দরবান থেকেই ঢাকায় ফিরতে চাইলে অগ্রীম টিকেট কেটে রাখুন। তাছাড়া ঝামেলায় পড়তে পারেন। হোটেল, রিসোর্ট কিংবা গাইডের যোগাযোগ নাম্বার লাগলে জানাতে পারেন, সহযোগীতা করার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ্।
কিছু জরুরী কথা:
১. ছুঁটির দিন ও মৌসুম এড়িয়ে আসলে খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব।
২. পাহাড়ে বেশীরভাগই আদিবাসীদের বসবাস। তাদের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতিকে কোন ভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না। তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। তাদের সাথে ভালো আচরণ করুন। তারা অনেক ভালো মনের মানুষ ও সাহায্যকারী।
৩. কোন সমস্যায় পড়লে ট্যুরিস্ট পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর সহযোগীতা নিন। তারা সদা প্রস্তুত সহযোগীতা করতে।
৪.দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় টেলিটক ও রবি সিম কার্ড ছাড়া অন্য কোম্পানির নেটওয়ার্ক তেমন পাওয়া যায় না।
৫. পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে আনুন।
৬. অনুনোমদিত কোন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন না।
৭. পরিবেশ পরিস্কার রাখুন, মনে রাখবেন একজন প্রকৃত পর্যটক ও প্রকৃতি প্রেমী কখনো পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে না।
৮. স্যালাইন, প্যারাসিটামল, গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ, স্যাভলন ও মশার অত্যাচার থেকে বাঁচার ক্রিম সাথে করে নিয়ে আসবেন।
ধৈর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। নিজে ভালো থাকুন, প্রাণের দেশটাকে ভালো রাখুন। আল্লাহ হাফেজ।
আলমগীর হোসেন
০৪.০৫.২০২০